Admission

বৈশাখ মাস বিবাহের মাস। আমি ১লা বৈশাখে নসী বাবুর ফুলবাগানে বসিয়া একটি বিবাহ দেখিলাম । ভবিষ্যৎ বরকন্যাদিগের শিক্ষার্থ লিখিয়া রাখিতেছি।
মল্লিকা ফুলের বিবাহ। বৈকাল-শৈশব অবসানপ্রায়, কলিকা-কন্যা বিবাহযোগ্যা হইয়া আসিল । কন্যার পিতা বড়োলোক নহে, ক্ষুদ্র বৃক্ষ, তাহাতে আবার অনেকগুলি কন্যাভারগ্রস্ত। সম্বন্ধের অনেক কথা হইতেছিল, কিন্তু কোনটা স্থির হয় নাই। উদ্যানের রাজা স্থলপদ্ম নির্দোষ পাত্র বটে, কিন্তু ঘর বড়ো উঁচু, স্থলপদ্ম অত দূর নামিল না। জবা এ বিবাহে অসম্মত ছিল না, কিন্তু জবা বড়ো রাগী, কন্যাকর্তা পিছাইলেন । গন্ধরাজ পাত্র ভালো, কিন্তু বড়ো দেমাগ, প্রায় তাঁহার বর পাওয়া যায় না। এইরূপ অব্যবস্থার সময়ে ভ্রমররাজ ঘটক হইয়া মল্লিকা-বৃক্ষসদনে উপস্থিত হইলেন। তিনি আসিয়া বলিলেন, ‘গুণ ! গুণ ! গুণ মেয়ে আছে?'
মল্লিকাবৃক্ষ পাতা নাড়িয়া সায় দিলেন, ‘আছে!' ভ্রমর পত্রাসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, ‘গুণ গুণ গুণ! গুণ গুণাগুণ! মেয়ে দেখিব।'
বৃক্ষ, শাখা নত করিয়া মুদিতনয়না অবগুণ্ঠনবতী কন্যা দেখাইলেন ।
ভ্রমর একবার বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘গুণ্ ! গুণ! গুণ ! গুণ দেখিতে চাই। ঘোমটা খোল ৷
লজ্জাশীলা কন্যা কিছুতেই ঘোমটা খুলে না। বৃক্ষ বলিলেন, ‘আমার মেয়েগুলি বড়ো লাজুক। তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি মুখ দেখাইতেছি।'

ভ্রমর ভোঁ করিয়া স্থলপদ্মের বৈঠকখানায় গিয়া রাজপুত্রের সঙ্গে ইয়ারকি করিতে বসিলেন। এদিকে মল্লিকার সন্ধ্যাঠাকুরাণী-দিদি আসিয়া তাহাকে কত বুঝাইতে লাগিল— বলিল, “দিদি, একবার ঘোমটা খোল– নইলে, বর আসিবে না – লক্ষ্মী আমার, চাঁদ আমার, সোনা আমার, ইত্যাদি ।' কলিকা কতবার ঘাড় নাড়িল, কতবার রাগ করিয়া মুখ ঘুরাইল, কতবার বলিল, 'ঠান্‌দিদি, তুই যা !' কিন্তু শেষে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ স্বভাবে মুগ্ধ হইয়া মুখ খুলিল। তখন ঘটক মহাশয় ভোঁ করিয়া রাজবাড়ি হইতে নামিয়া আসিয়া ঘটকালিতে মন দিলেন। কন্যার পরিমলে মুগ্ধ হইয়া বলিলেন, ‘গুণ গুণ গুণ গুণ গুণাগুণ ! কন্যা গুণবতী বটে । ঘরে মধু কত?’
কন্যাকর্তা বৃক্ষ বলিলেন, 'ফর্দ দিবেন, কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিবে।' ভ্রমর বলিলেন, ‘গুণ গুণ, আপনার অনেক গুণ — ঘটকালিটা?'
কন্যাকর্তা শাখা নাড়িয়া সায় দিল, 'তাও হবে।'
ভ্রমর— 'বলি ঘটকালির কিছু আগাম দিলে হয় না?' নগদ দান বড়ো গুণ-গুণ গুণ গুণ ।’ ক্ষুদ্র বৃক্ষটি তখন বিরক্ত হইয়া, সকল শাখা নাড়িয়া বলিল, আগে বরের কথা বল— বর কে?’ ভ্রমর— ‘বর অতি সুপাত্র।— তাঁর অনেক গুণ-- ণ।'
এ সকল কথোপকথন মনুষ্যে শুনিতে পায় না, আমি কেবল দিব্য কর্ণ পাইয়াই এ সকল শুনিতেছিলাম । আমি শুনিতে লাগিলাম, কুলাচার্য মহাশয়, পাখা ঝাড়িয়া, ছয় পা ছড়াইয়া গোলাবের মহিমা কীর্তন করিতেছিলেন। বলিতেছিলেন যে, গোলাব বংশ বড়ো কুলীন; কেন না, ইহারা ‘ফুলে’ মেল। যদি বল, সকল ফুলই ফুলে, তথাপি গোলাবের গৌরব অধিক; কেন না, ইহারা সাক্ষাৎ বাঞ্ছামালির সন্তান; তাহার স্বহস্তরোপিত । যদি বল, এ ফুলে কাঁটা আছে, কোন্ কুলে বা কোন্ ফুলে নাই ?
যাহা হউক, ঘটকরাজ কোনরূপে সম্বন্ধ স্থির করিয়া, বোঁ করিয়া উড়িয়া গিয়া, গোলাব বাবুর বাড়িতে খবর দিলেন। গোলাব, তখন বাতাসের সঙ্গে নাচিয়া নাচিয়া, হাসিয়া হাসিয়া, লাফাইয়া লাফাইয়া খেলা করিতেছিল, বিবাহের নাম শুনিয়া আহ্লাদিত হইয়া কন্যার বয়স জিজ্ঞাসা করিল। ভ্রমর বলিল, ‘আজি কালি ফুটিবে।'
গোধূলি লগ্ন উপস্থিত, গোলাব বিবাহে যাত্রার উদ্‌যোগ করিতে লাগিলেন । উচ্চিঙ্গড়া নহবৎ বাজাইতে আরম্ভ করিল ; মৌমাছি সানাইয়ের বায়না লইয়াছিল, কিন্তু রাতকানা বলিয়া সঙ্গে যাইতে পারিল না। খদ্যোতেরা ঝাড় ধরিল ; আকাশে তারাবাজি হইতে লাগিল। কোকিল আগে আগে ফুকরাইতে লাগিল। অনেক বরযাত্রী চলিল; স্বয়ং রাজকুমার স্থলপদ্ম দিবাবসানে অসুস্থকর বলিয়া আসিতে পারিলেন না, কিন্তু জবাগোষ্ঠী— শ্বেত জবা, রক্ত জবা, জরদ জবা প্রভৃতি সবংশে আসিয়াছিল । করবীদের দল, সেকেলে রাজাদিগের মতো বড়ো উচ্চ ডালে চড়িয়া আসিয়া উপস্থিত হইল । সেঁউতি নীতবর হইবে বলিয়া, সাজিয়া আসিয়া দুলিতে লাগিল। গরদের জোড় পরিয়া চাঁপা আসিয়া দাঁড়াইল – উগ্র গন্ধ ছুটিতে লাগিল। গন্ধরাজেরা বড়ো বাহার দিয়া, দলে দলে আসিয়া, গন্ধ বিলাইয়া দেশ মাতাইতে লাগিল। অশোক নেশায় লাল হইয়া আসিয়া উপস্থিত; সঙ্গে একপাল পিপড়া মোসায়েব হইয়া আসিয়াছে; তাহাদের গুণের সঙ্গে সম্বন্ধ নাই, কিন্তু দাঁতের জ্বালা বড়ো- কোন বিবাহে না এরূপ বরযাত্রী জোটে, আর কোন বিবাহে না তাহারা হুল ফুটাইয়া বিবাদ বাধায়? কুরুবক কুটজ প্রভৃতি আরও অনেক বরযাত্রী আসিয়াছিলেন, ঘটক মহাশয়ের কাছে তাঁহাদের পরিচয় শুনিবেন। সর্বত্রই তিনি যাতায়াত করেন এবং কিছু কিছু মধু পাইয়া থাকেন ।
আমারও নিমন্ত্রণ ছিল, আমিও গেলাম। দেখি, বরপক্ষের বড়ো বিপদ। বাতাস বাহকের বায়না লইয়াছিলেন; তখন হুঁ-হুম করিয়া অনেক মর্দানি করিয়াছিলেন, কিন্তু কাজের সময় কোথায় লুকাইলেন, কেহ খুঁজিয়া পায় না। দেখিলাম, বর বরযাত্রী, সকলে অবাক হইয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া আছেন। মল্লিকাদিগের কুল যায় দেখিয়া, আমিই বাহকের কার্য স্বীকার করিলাম। বর, বরযাত্রী সকলকে তুলিয়া লইয়া মল্লিকাপুরে গেলাম ।
সেখানে দেখিলাম, কন্যাকুল, সকল ভগিনী, আহ্লাদে ঘোমটা খুলিয়া মুখ ফুটাইয়া, পরিমল ছুটাইয়া, সুখের হাসি হাসিতেছে। দেখিলাম, পাতায় পাতায় জড়াজড়ি, গন্ধের ভাণ্ডারে ছড়াছড়ি পড়িয়া গিয়াছে —রূপের ভারে সকলে ভাঙিয়া পড়িতেছে। যূথি, মালতী, বকুল, রজনীগন্ধা প্রভৃতি এয়োগণ স্ত্রী-আচার করিয়া বরণ করিল । দেখিলাম, পুরোহিত উপস্থিত; নসী বাবুর নবমবর্ষীয়া কন্যা (জীবন্ত কুসুমরূপিণী) কুসুমলতা সূচ সুতা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে; কন্যাকর্তা কন্যা সম্প্রদান করিলেন; পুরোহিত মহাশয় দুইজনকে এক সূতায় গাঁথিয়া গাঁটছড়া বাঁধিয়া দিলেন ।
তখন বরকে বাসর-ঘরে লইয়া গেল। কত যে রসময়ী মধুময়ী সুন্দরী সেখানে বরকে ঘিরিয়া বসিল, তাহা কি বলিব। প্রাচীনা ঠাকুরাণীদিদি টগর সাদা প্রাণে বাঁধা রসিকতা করিতে করিতে শুকাইয়া উঠিলেন । রঙ্গণের রাঙ্গামুখে হাসি ধরে না। যুই, কন্যের সই, কন্যের কাছে গিয়া শুইল; রজনীগন্ধাকে বর তাড়কা রাক্ষসী বলিয়া কতো তামাসা করিল; বকুল একে বালিকা, তাতে যত গুণ, তত রূপ নহে; এককোণে গিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; আর ঝুমকা ফুল বড়ো মানুষের গৃহিণীর মতো মোটা নীল শাড়ি ছড়াইয়া জমকাইয়া বসিল । তখন—
‘কমলকাকা—ওঠ বাড়ি যাই- রাত হয়েছে, ও কি, ঢুলে পড়বে যে?' কুসুমলতা এই কথা বলিয়া আমার গা ঠেলিতেছিল; – চমক হইলে, দেখিলাম কিছুই নাই। সেই পুষ্পবাসর কোথায় মিশিল? – মনে - করিলাম, সংসার অনিত্যই বটে— এই আছে এই নাই। সে রম্য বাসর কোথায় গেল, – সেই হাস্যমুখী শুভ্রস্মিতসুধাময়ী পুষ্পসুন্দরীসকল কোথায় গেল? যেখানে সব যাইবে, সেইখানে— স্মৃতির দর্পণতলে, ভূতসাগরগর্ভে। যেখানে রাজা প্রজা, পর্বত সমুদ্র, গ্রহ নক্ষত্রাদি গিয়াছে বা যাইবে, সেইখানে – ধ্বংসপুরে! এই বিবাহের ন্যায় সব শূন্যে মিশাইবে, সব বাতাসে গলিয়া যাইবে । কুসুম বলিল, “ওঠ না— কি কচ্চো?
আমি বলিলাম, ‘দূর পাগলি, আমি বিয়ে দিচ্ছিলাম।'

কুসুম ঘেঁষে এসে, হেসে হেসে কাছে দাঁড়াইয়া আদর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কার বিয়ে, কাকা ?” আমি বলিলাম, ‘ফুলের বিয়ে।'
‘ওঃ পোড়া কপাল, ফুলের? আমি বলি কি! আমিও যে এই ফুলের বিয়ে দিয়েছি।'
'কই?'
‘এই যে মালা গেথেঁছি ।' দেখিলাম, সেই মালায় আমার বর কন্যা রহিয়াছে।

 

Content added || updated By

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ২৬শে জুন ১৮৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সে বছরই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে চাকরিতে নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্ৰ তেত্রিশ বছর একই পদে চাকরি করে ১৮৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পাঠ্যাবস্থায়ই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে বাংলা উপন্যাস রচনার পথিকৃৎ হিসেবে। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী বাংলা কথাসাহিত্যে এক নবদিগন্ত উন্মোচন করে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস হলো : কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়, রাধারানী, চন্দ্রশেখর, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম। প্রবন্ধ-সাহিত্যেও বঙ্কিমচন্দ্র কৃতিত্ব দেখিয়েছেন । কমলাকান্তের দপ্তর, লোকরহস্য, কৃষ্ণ চরিত্র ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

Content added || updated By

কন্যাভারগ্রস্ত - বিবাহযোগ্যা কন্যা বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বহনকারী অর্থে।সম্বন্ধের - বিয়ের। কন্যাকর্তা - কন্যার অভিভাবক। পত্রাসন – পাতার ওপর আসন। অবগুণ্ঠনবতী — ঘোমটা দেওয়া। ইয়ারকি – বন্ধুদের সঙ্গেই করা চলে এমন আলাপ। সন্ধ্যাঠাকুরাণী দিদি – এখানে সন্ধ্যাকালকে দিদি বলে সম্বোধন করা হয়েছে। পরিমল – সুগন্ধ। গন্ধোপাধ্যায় - গন্ধের রাজা বোঝাতে। কুলাচার্য – কুলের আচার্য বা বংশের প্রধান পুরোহিত। বাঞ্ছামালি – যে মালি ইচ্ছামতো ফুল ফোটাতে পারে। খদ্যোত - জোনাকি পোকা। এয়োগণ - সধবা নারী। কমলকাকা - কমলাকান্তকে কাকা বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

Content added By

এই রচনায় হাস্যরসের মাধ্যমে বিভিন্ন ফুলের নাম, সে ফুলগুলোর গন্ধের তারতম্য, বর্ণের রকমফের অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন বঙ্কিমচন্দ্র । কখন কোন ফুল ফোটে সে পর্যবেক্ষণও এই রচনায় পাওয়া যায়। বিয়ে-অনুষ্ঠান বাঙালির জীবনে, বিশেষ করে বাড়ির শিশু-কিশোর ও প্রতিবেশীদের মধ্যে অতীব আনন্দ নিয়ে আসে। এই অনুষ্ঠানে বর-কনে কেন্দ্রে থাকলেও বর-কনের মাতা-পিতা, কনের পড়শি নারীরা নানা মাঙ্গলিক ব্রতে সম্পৃক্ত থাকেন, ঘটকও থাকেন বিশেষভাবে যুক্ত। বিয়ে অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকেন এমন নানা ব্যক্তির পরিবর্তে বিভিন্ন ফুলের উল্লেখ করে অসাধারণ দক্ষতায় বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির গার্হস্থ্য একটি অনুষ্ঠানকে আরো আনন্দদায়ক করে এখানে উপস্থাপন করেছেন। এখানে লেখক প্রকৃতিকে বাস্তব জীবনে উপস্থাপনে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর এই রচনাভঙ্গি ও সাহিত্যবোধ বাংলা গদ্য সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘ফুলের বিবাহ’ গদ্যটি কৌতূহলী ও পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সহায়ক

Content added By